নিচে কাজী আবদুল ওদুদের (১৮৯৪-১৯৭০) একটি প্রবন্ধ দেওয়া হলো। এটি তাঁর 'শাশ্বত বঙ্গ' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। কাজী আবদুল ওদুদ 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বাংলার জাগরণ', 'কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ', 'নজরুল প্রতিভা' ইত্যাদি। তাঁর একটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম 'নদীবক্ষে'।
এই প্রবন্ধ থেকে বিভিন্ন ধরনের লগ্নক শনাক্ত করো এবং প্রদত্ত ছকে লেখো।
কাজী আবদুল ওদুদ
সাহিত্য-জগৎ বলে একটা স্বতন্ত্র স্বয়ং-পূর্ণ জগৎ আছে কি? যাঁরা 'শিল্পের জন্য শিল্প'-বাদী তাঁরা সোৎসাহে বলে উঠবেন: নিশ্চয়ই। তাঁদের দলে কৃতী সাহিত্যিকের অভাব নেই, তবু তাঁদের দলে ভিড়তে স্বতই সংকোচ জাগে, বিশেষ করে এই যুগে। মানব-কল্যাণ জীবন-কল্যাণ তত্ত্ব সব শিরোধার্য করেও সাহিত্য-প্রচেষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে না বলে যেন উপায় থাকে না যে, সাহিত্য-জগৎ একটা স্বত্য জগত।
কথাটা মনে পড়ছে কয়েকজন তরুণ বন্ধুর সাহিত্য-প্রচেষ্টা দেখে। বোঝা যাচ্ছে, আন্তরিকতায় তাঁদের ত্রুটি নেই, বাস্তবিকই তাঁরা কিছু একটা করতে চাচ্ছেন বা হতে চাচ্ছেন, আর তাঁদের দৃষ্টিও সাহিত্যের জগতের দিকে। তবু মনে হচ্ছে, যে পথে তাঁরা অগ্রসর হচ্ছেন তা ঠিক সাহিত্যের পথ নয়।
সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যা, নর-নারীর সমস্যা, সব বিষয়ে তাদের কৌতুহল যথেষ্ট তীব্র, কিন্তু মনে হচ্ছে সেই তীব্রতা এতখানি যে, সেই জন্যই সাহিত্যের সুর তাতে ঠিক লাগছে না। সাহিত্য সমস্ত সমস্যারই আলোচনার ক্ষেত্র হতে পারে, হয়েও এসেছে চিরকাল, এমনকি যখন হয়নি তখনই সাহিত্য স্বাদহীন পানসে হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই আলোচনার একটা বিশিষ্ট ধরন আছে-যেমন নাচের একটা বিশিষ্ট ধরন আছে, তার বাইরে গেলেই তা মাত্র লাফালাফি।
সাহিত্যের সেই ধর্মের একটি নাম মাত্রা-বোধ। সাহিত্য অনুভূতির প্রকাশক্ষেত্র-মাত্র নয়, অনুভূতির সুপ্রকাশ-ক্ষেত্র। সেই সুপ্রকাশের সঙ্গে কৌতূহল এবং স্থৈর্য গাম্ভীর্য এবং ব্যঙ্গ আশ্চর্যভাবে মিশ্রিত। এই সব পরস্পর-বিরোধিতার যেখানে মিলন ঘটেছে, সেখানেই সাহিত্যিক-শ্রী দেখা দিয়েছে। শুধু উৎসুক্য, শুধু গাম্ভীর্য মূল্যহীন নয় কখনো, কিন্তু যত মূল্যবানই হোক সাহিত্যিক-শ্রী থেকে বঞ্চিত।
মনে হতে পারে তাহলে তো সাহিত্যে 'শিল্পের জন্য শিল্প'-বাদীদের মতই সত্য। এক হিসেবে এ কথা মিথ্যা নয়, কিন্তু 'শিল্পের জন্য শিল্প'-বাদে এমন একটা স্বস্তিবোধ রয়েছে, যাকে স্বাভাবিক ভাবা কঠিন। গাছে যে ফুল হয় তা গাছের কান্ড, ডালপালা ও পাতা থেকে স্বতন্ত্র নিশ্চয়ই। কিন্তু স্বতন্ত্র হয়েও তা গাছের অংশ ভিন্ন আর কিছু নয়। সাহিত্যও তেমনি, হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-বিকার-ব্যর্থতাময় যে জীবন তারই একটি প্রকাশ। সেই বিরাট জীবনের সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগ নষ্ট হলে, তা হয়ে পড়ে অদ্ভুত এবং অসার। যেমন সত্যিকার ফুলের সঙ্গে তুলনায় কাগজের ফুল অদ্ভুত এবং অসার।
সাহিত্য জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। আবার তার থেকে এক হিসেবে স্বতন্ত্র। এ কথাটা পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে।
ব্যাপারটা বাস্তবিকই বড়ো জটিল। তবে কিছু বোঝা যায় যদি এই কথা মনে রাখা যায়: জীবন থেকে সাহিত্যের জন্ম হলেও তার সঙ্গে সাহিত্যের পার্থক্য এই যে, তা জীবনের মতো অস্থির, অপূর্ণাঙ্গ ও সতত পরিবর্তনশীল নয়। বরং, এই সতত পরিবর্তনশীল জীবনের বুকে সে যেন এক অচঞ্চল স্বপ্ন, তা যত অল্পক্ষণের জন্যেই হোক।
যে পূর্ণাঙ্গতা আমাদের জীবনে নেই, তারই সাধনা করি বা স্বপ্ন দেখি সাহিত্যে। এই পূর্ণাঙ্গতার জন্যেই অবশ্য স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গতা, সাহিত্য-জগৎ বাস্তবিকই একটু স্বতন্ত্র জগৎ।
আরও দেখুন...